কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলার বিদ্রোহের কণ্ঠস্বর
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ প্রতিভার নাম। কবিতা, নাটক, উপন্যাস ও সংগীত সহ সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রে ছিল তার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর ও অবাধ বিচরণ। তিনি নিজে গান লিখতেন এবং সেই গানের সুর নিজেই দিতেন আবার নিজেই গাইতেন সেই গান। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন এবং অধিকার আদায় করতে গিয়ে নানা আন্দোলন করেছিলেন।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলামের অবস্থান ছিল বলে তাকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
কাজী নাজরুল ইসলামের পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম ছিল জাহেদা বেগম। নার্গিস আসার খনমের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম বিয়ে হয়। তার প্রথম বউ এর সাথে তিনি ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং পরে আশালতা সেনগুপ্ত (প্রমিলা দেবী) কে বিয়ে করেন।
কাজী নজরুল ইসামের চার জন সন্তান ছিল এবং তাদের নাম হল – কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনে শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয়ে মাত্র দশ বছর বয়সেই কর্মজীবন শুরু করতে বাধ্য হন। মক্তবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করার পাশাপাশি হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক ও মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এসব কাজের মধ্য থেকেই পরবর্তীকালে সাহিত্য কর্মে বিপুলভাবে আকৃষ্ঠ হয়ে পড়ে।
তবে বাল্য বয়সের স্থানীয় লোকসঙ্গীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা বশবর্তী হয়েই লেটো (ভাম্রমান নাট্য দল) দলে যোগদান করেন। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রাককালে সৈন্যদলে যোগ দেন করেন। এছাড়াও মোক্তবেও শিক্ষকতার কাজও করেন। এছাড়াও তিনি সাংবাদিকতার কাজও করেন।
নজরুল অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে “ অগ্নিবীণা”, “ বিষের বাঁশি”,”সাম্যবাদী”, “ সর্বহারা ইত্যাদি”। তাঁর লেখা ধাধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, ব্যাথার দান, রিক্তের বেদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা।
নজরুল বিদ্রোহের কবি, বৈভবের কবি। কিন্তু কার বিরুদ্ধে তাঁর এই বিদ্রোহ বা জেহাদ? আসলে যেখানেই তিনি দেখেছেন মানবতার লাঞ্ছনা, দেখেছেন ধর্মের ছদ্মবেশে মানবিক অধিকার-হরণ। লাঞ্ছিত মানবতা তাঁর কবি-কল্পনাকে আলোড়িত করে । তাঁর কাবে তাই প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর উচ্ছল যৌবনেরই পদধ্বনি। তিনি তরুণ মনে সঞ্চার করেন যৌবনের উদ্দাম গতির ছন্দ। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দেশবাসীকে করেন চঞ্চল, আবেগ-অস্থির।
বিদ্রোহী” কবিতাটিতে নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেন। তিনি সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেন। এই কবিতাটি প্রকাশের পর নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহী কবি” উপাধি দেন প্রমথ চৌধুরী। ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর, ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত “বিদ্রোহী” কবিতাটি প্রকাশের পর প্রমথ চৌধুরী এই উপাধি দেন।
বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর লেখার উপর গবেষণা চালাচ্ছে। তিনি ফরাসি ভাষার মহাকবি হাফিজের কতগুলো কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ কবিতা ও সাহিত্য রুশ ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
কাজী নজরুল ইসলাম এর লেখা গান নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত। তিনি চার হাজারের অধিক গান লিখে যান। বেশির ভাগ গানে তিনি নিজেই সুর দিয়ে যান। তার লেখা কিছু বিখ্যাত গান হল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘চল চল চল’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’ ইত্যাদি।
পুরস্কার ও সম্মাননা:-
১৯৪৫ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি ‘জগত্তারিনী’ পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
১৯৬০ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৭০ সালের বিশ্বভারতী কবিকে ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৭৩ সালে কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে কবি কে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার কবিকে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে।
কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশের প্রতিলিপি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে।
১৯৪২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক দূরারগ্য ব্যধিতে ব্যধিতে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য দেশের সকল প্রকার চিকিৎসা ব্যর্থ হবার পর ১৯৫৩ সালে সুচিকিৎসার জন্য তাকে সরকারি ব্যবস্থা মাধ্যমে লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও কবিকে রোগ মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর বাংলার ১৩৮৩ সালের ১২ই ভাদ্র (29th August, 1976) এই বিখ্যাত মনীষী পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন
Comments.