কলকাতা বইমেলা মানেই বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ
১৯৭৬ সালের কলিকাতা পুস্তকমেলা-ই আজকের আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা। ১৯৮৪ সালে এই বইমেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। প্রতিবছর এই বইমেলা হয়ে ওঠে বইপ্রেমীদের দুর্গাপুজো। ঠিক এই কারণেই কলকাতা বইমেলাকে বলা হয় বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ। কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা। কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই মেলা একটি বিশেষ স্থানের অধিকারী। কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলা হলেও মেলার সিংহভাগ জুড়ে বাংলা বইয়ের বিক্রিই বেশি হয়। তবে প্রচুর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশক ও বিক্রেতাও এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি অন্যান্য ভারতীয় ভাষার বইও এই মেলায় পাওয়া যায়। বিদেশি দূতাবাসগুলিও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রকাশিত বইপত্রের প্রদর্শনী করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের বাংলা প্রকাশনা বিভাগগুলিও এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ এবং অন্য একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। গ্রন্থসম্ভারের পাশাপাশি শিশু, তথ্যপ্রযুক্তি ও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিশেষ চত্বর নির্ধারিত থাকে। কলকাতা বইমেলা বর্তমানে কলকাতার সবথেকে জনপ্রিয় একটি মেলা।
উদ্বোধনী দিন সহ মোট ১৪ দিন ধরে চলা এই বই উৎসবে যোগ দেন লাখ লাখ পাঠক। নামে বইমেলা হলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে, সাম্প্রতিক কালে বই ছাড়াও খাবার-দাবার, অলঙ্কার-জুয়েলারি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রীর দোকানেরও দেখা মেলে বইমেলায়। তা সত্ত্বেও মেলা আছে মেলাতেই। পরিসংখ্যান বলে, বইমেলায় সব থেকে বেশি বিক্রি হয় রান্নার বই, ভুতের গল্প আর রহস্য গল্প উপন্যাস। তবে প্রবন্ধ এবং কবিতার বইয়ের ক্রেতাও কম নেই। অর্থনীতি, সমাজনীতি, আঞ্চলিক ইতিহাস এমনকি জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থেরও একটা ভালো বাজার রয়েছে কলকাতা বইমেলায়।
কিছুকাল আগেও পুজোর পর থেকেই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া আর রাজাবাজারের দপ্তরিপাড়ায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ আরম্ভ হয়ে যেত আসন্ন বইমেলার জন্য। সে সময়ে অনেক প্রকাশককেই আক্ষেপ করতে শোনা যেত, সময়মতো ছাপা বা বাঁধাই না হওয়ার জন্য অনেকগুলো বইমেলায় প্রকাশ করা গেল না বলে! প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সে আক্ষেপও অনেক কমেছে। সেই সঙ্গে ছাপায় ‘প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড’ বা ‘পিওডি’ পদ্ধতি আসায়, বাংলা মুদ্রণে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে বলা যায়। যদিও এই ‘পিওডি’ পদ্ধতিতে ছাপা বইয়ের সংস্করণ বা মুদ্রণ সংখ্যা নিয়ে পাঠকবর্গের অনেকের কিছু অভিযোগ আছে। ‘হ্যান্ড-কম্পোজ’ যুগে কোনও গ্রন্থের সংস্করণ বলতে এগারোশো কপি বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাঁচশো কপি বোঝানো হত। কিন্তু, অত্যাধুনিক ‘পিওডি’ মুদ্রণ যুগে মাত্র কুড়ি কপি ছেপেও বই বের করা সম্ভব। এবং অভিযোগ, অনেক প্রকাশক ওই অতি অল্প সংখ্যক মুদ্রণকেও একটা সংস্করণ বলে দাবি করছেন। এ ছাড়াও ‘পিওডি’ পদ্ধতিতে মুদ্রিত বইয়ের স্থায়িত্ব সম্পর্কেও অনেকে সন্দিহান! লেখক-প্রকাশক-মুদ্রক বই তৈরি করেন কিন্তু কোন বই গ্রহণযোগ্য তার শেষ বিচারটা করবেন পাঠকবর্গই। আধুনিক প্রযুক্তি সব সময়েই স্বাগত তবে তা যেন পাঠকদের স্বস্তি দেয়, তবেই বইলেখা, বইছাপা এবং বইমেলা সার্থক হয়ে উঠতে পারে।
Comments.