কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। তিনি বাংলা কাব্য ও সাহিত্যের প্রচন্ড বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। দেশে স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি কলমকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার কবিতা, গান, নাদ, গজল, গল্প এবং উপন্যাস প্রতিটি বাঙালির মনকে করে তুলেছিল জাগরিত। তিনি ছিলেন একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা :
কাজী হচ্ছে তাদের বংশের উপাধি। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের মতোয়াল্লি। ফলে ছোটবেলা থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামিক চিন্তা ও ভাবধারা নিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। বাল্যকালে তিনি নিকটস্থ মক্তবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তিনি বাংলা ও আরবি ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষা কেন্দ্রে ফরাসি ভাষা শিখতে থাকেন।
১৯০৮ সালে যখন নজরুল ইসলামের বাবা মারা যান তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। সংসারে নেমে আসে অভাব, অনটন ও দুঃখ দুর্দশা। লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ জীবিকা অর্জনের জন্য মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁকে কাজে নামতে হয়। সেই সময় মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি সেখানেই শিক্ষকতা করা শুরু করেন। এরপর তিনি লেটো দলে যোগ দেন এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই সুখ্যাতি অর্জন করেন।

অসাধারণ প্রতিভার বলে তিনি লেটো দলের প্রধান নির্বাচিত হন। লেটো গানের দলে থেকেই তিনি বিভিন্ন বই পত্র পড়ে সাহিত্যচর্চায় চালিয়ে যান। এ সময় তিনি কয়েকটি কবিতা, ছড়া গান ও পালাগান রচনা করে অসম্মান্য দক্ষতার পরিচয় দেন।

এরপর তিনি শিক্ষালাপের জন্য গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতায় রানীগঞ্জ শেয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। শৈশবকাল থেকে তিনি ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির। স্কুলের বাধা ধরা নিয়ম কানুন তিনি একদমই সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে উধাও হন। কিন্তু কোথায় যাবেন, কি খাবেন, কি করে চলবেন ইত্যাদি চিন্তা করে এবং আর্থিক অভাব অনটনের কারণে তিনি আসানসলের এক রুটির দোকানে মাত্র পাঁচ টাকার মাসিক বেতনে চাকরি নেন। রুটি তৈরির ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন কবিতা, গান, গজল ইত্যাদি রচনা করেন এবং বিভিন্ন বই পত্র পড়ে তাঁর ঞ্জান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং ময়মনসিংহ জেলার ডালিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। এরপর তিনি পুনরায় রানীগঞ্জের শেয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন।


১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।  প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তিনি নওশেরায় যান এবং প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে একজন সৈনিক হিসেবে  জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, তাঁর সৈনিক জীবনের প্রায় আড়াই বছরের সময়কালে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। রেজিমেন্টে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি ফার্সি ভাষা শিখছিলেন; দেশী-বিদেশী নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন  তিনি আর তার পাশাপাশি গদ্য-পদ্যের চর্চাও চালিয়ে গিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম করাচি সেনানিবাসে কর্মরত অবস্থায় বহু রচনা সম্পাদন করেছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ,বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা)।  তাঁর রচিত গল্পগুলির  মধ্যে অন্যতম হল, হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সেই সময়ে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধের অবসান ঘটলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম উঠেছিল নজরুলের। মহাযুদ্ধের স্মৃতি এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবাগ্নি জ্বালিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন বাংলার অখ্যাত হাবিলদার কবি ।

বিদ্রোহী যৌবনের কবি:
নজরুল চিরযৌবনের কবি। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অনিবার্য আশাভঙ্গ হেতু সেই যৌবন, বিদ্রোহ ধর্মী হয়ে ওঠে। সর্বপ্রকার শোষণ -শাসন -শৃঙ্খলা সবলে ভাঙবার দুর্জয় সাধনায় তিনি ছিলেন ব্রতচারী।প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে প্রত্যাগত নজরুলের কাব্যে শোনা গিয়েছিল সেই বিদ্রোহী যৌবনের নির্বাধ পদধ্বনি। রবীন্দ্রনাথ ও বিস্মিত  স্নেহে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
বিদ্রোহী কবি : 
বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন  করে নজরুল দেখেন যে দেশব্যাপী পরাধীনতার করাল অন্ধকারে ধনী  শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জের শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে এক বিশাল শ্মশানভূমি। তিনি উদ্ধত কাপালিকের মতো উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর সেই চির-পরিচিত ভৈরবী মন্ত্রটি ; "কারার ওই লৌহ কপাট; ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী" বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে  ঘোষণা করেছিলেন ,"আমি বেদুইন ,আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ"। কবির বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে তেমনি তাঁর  বিদ্রোহ ছিল সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও ।তাঁর দৃষ্টিতে সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদ কৃত্রিম এবং মিথ্যে। তাঁর রচিত, 'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশি', 'সর্বহারা', 'ফণিমনসা', 'ছায়ানট' প্রভৃতি কাব্যগুলো মূলত বিদ্রোহেরই সোচ্চার জয়ধ্বনি। কাজী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্র এবং মঞ্চ জগতের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন । ১৯৩১ সালে 'ভক্ত ধ্রুব' ছবিতে নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং সুরারোপও করেন। গানের জগতে এপার বাংলা ওপার বাংলায় রবীন্দ্রসংগীতের পরেই নজরুলগীতি স্থান। সুরকার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম । তিনি প্রায় আড়াই হাজারের বেশি গান রচনা করেছিলেন। তাঁর গানের পরিচিতি দেশে- বিদেশে ছড়িয়ে আছে।তাঁর জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে বুলবুল, চোখের চাতক,গুলবাগিচা ,গীতিমাল্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে নজরুল :
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায় নজরুল ইসলামকে। এই উপলক্ষে কবি লেখেন 'হিন্দু মুসলিম', 'পথের দিশা', 'মন্দির ও মসজিদ, প্রভৃতি প্রবন্ধ।কলকাতা তথা সারা বাংলা যখন রক্তাক্ত ,তখন দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ তাঁর সত্য বিশ্বাসকে দারুণভাবে ধাক্কা দেয়। তিনিই প্রথম শেখালেন, "মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু -মুসলমান ;মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ"। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের মতো চণ্ডাল ,মুচি, মেথর ,সমস্ত ভারতবাসীকে এক আসনে দেখতে চেয়েছিলেন। সামাজিক অবক্ষয়ও  অন্যায় অবিচার তাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল।

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen