সঙ্গীত জগতের ধ্রুবতারা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ১৬ ই জুন পবিত্র বারাণসী শহরে নিজের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিলেন কালিদাস মুখোপাধ্যায় এবং মাতা কিরণবালা দেবী। হেমন্ত কুমারের মাতামহ একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত জয়নগরে তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল। পরবর্তীতে ১৯২২ সালে তাঁর পরিবার কলকাতা শহরে চলে আসেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তিন ভাই এবং এক বোন ছিল। বোনের নাম ছিল নীলিমা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শক্তিদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন চাকরিরত, অন্যদিকে সেজো ভ্রাতা তারাজ্যোতি ছিলেন ছোটো গল্প লেখক। হেমন্ত কুমারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অমল মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন এবং গানও গেয়েছিলেন।

 

সংগীত জগতে প্রবেশ: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মনে একসময় সংগীতের প্রতি মোহ এতটাই বেড়ে যায় যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। জীবনের প্রথমদিকে তাঁর সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বেশ কিছুদিন দেশ পত্রিকায় বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের দিক থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন সঙ্গীত জগতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করতেন প্রখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিককে। তাই তাঁর ডাকনাম রাখা হয়েছিল 'ছোটো পঙ্কজ'।

আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রতি তাঁর সম্ভ্রম বোঝাতে হেমন্ত লিখছেন- “আমি তখন পঙ্কজদার ঢঙে গান গাইছি। আমাকে দেখে অনেকে বলে জুনিয়ার পঙ্কজ। খুব বাহবা দেয়। তখনও আমার সঙ্গে পঙ্কজদার আলাপ পরিচয় নেই। খুব ইচ্ছে হলো একদিন আলাপ করবার। ...একদিন সাহসে ভর করে গেলাম ওঁর সেবক বৈদ্য স্ট্রীটের বাড়িতে। বাড়িতে পেলাম ওঁকে। খুব সঙ্কোচের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলাম। উনি শুনে বললেন, ‘ও, তুমিই হেমন্ত? বাঃ বেশ। বেশ ভাল গান করো। আচ্ছা আচ্ছা।’ ... ওই কটা কথা বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। গাড়ি ছাড়বার আগে মুখ বাড়িয়ে আমাকে বললেন ‘আমি নিউ থিয়েটার্স যাচ্ছি, তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম আমি ভবানীপুরে। উনিই একাই চলে গেলেন টালিগঞ্জের দিকে।’”

ওই সময় থেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের তরুণ অনুরাগীরা পঙ্কজ আর হেমন্ত দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছেন এ কথা অনেকেই বলতেন। হেমন্ত অবশ্য এ কথা স্বীকার করতেন না। দক্ষিণ কলকাতার একটা অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দর্শকরা হেমন্তকে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু হেমন্ত  দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন ‘পঙ্কজদার সামনে ওই গান গাইতে পারব না। আমাকে মাফ করবেন।’ তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিমযাত্রায় এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের  আকাশবাণীর পুরনো বিল্ডিংয়ে সরাসরি সম্প্রচারে হেমন্ত গেয়েছিলেন, “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন”। কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন বাঙালিকে। এমন দরদী রবীন্দ্র সংগীত হয়তো বাঙালি প্রথম শুনল। আর তখন থেকেই হেমন্ত যুগের সূচনা।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত কুমার হওয়ার যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশের গোড়ায়। প্রথম সুর দেন হিন্দিতে ‘আনন্দ মঠ’ (১৯৫৩) ছবিতে। তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এরপর, ‘ডাকু কি লেডকি’, ‘নাগিন’, ‘সম্রাট’, ‘বন্দিশ’, ‘আনজান’ একের পর এক ছবিতে তাঁর সুরে হিট গান। ১৯৫৬ সালে ‘নাগিন’ সিনেমার জন্য সেরা সুরকার হিসাবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন। গুলজার তাঁর স্মৃতি কথায় বলছেন, 'বলিউডে একধারে গান গাইছেন, সুর করছেন, সিনেমা প্রোডিউস করছেন, ষাটের দশকে এমন কলার তোলা বাঙালি দেখা যেত না।'

কলার তোলা কাকে বলে তা তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। চিরকাল বাম মনোভাবাপন্ন হেমন্ত পদ্মশ্রী সম্মান নিতে অস্বীকার করেন। সারা জীবনে অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট সম্মান প্রদান করে। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন।

বাংলা তথা হিন্দি ছবির সঙ্গীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বলাই বাহুল্য যে বাঙালিদের গান ও সংস্কৃতি তিনি নিজের গানের মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সঙ্গীত জগতে রবীন্দ্র সঙ্গীত নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আকাশবানী রেডিওতে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, যা কবিগুরুর রচিত গানগুলোকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।

 

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen