বর্ষা ও রবীন্দ্রনাথ

“বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।”
হ্যাঁ, ভালোবাসার কবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের শ্রাবণের গান দিতে এসেছিলেন এবং দিয়েছেনও উজাড় করে। সাপ যেমন সাপুড়ের বীণে মোহাবিষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমন করে বাঙালিও রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। থাকবে অনন্তকাল।

পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে বর্ষা ঋতু স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা না পেলেও, এই বঙ্গভূমিতে পেয়েছে। আর বর্ষাকে মোহনীয় করেছেন কবিগুরু তার কাব্যসুধায়। বর্ষা প্রেমের ঋতু। বর্ষার বৃষ্টি ধারা যতটা তীব্র হয়, বাঙালির মনে প্রেমের বীণ ততটাই ঝংকার তুলে। প্রেমে পাগল বাঙালি তখন ছুটে যায় কবিগুরুর নীপবনে। নবধারা জলে স্নান করে বাঙালি খুঁজে পায় প্রেমের সার্থকতা।

 

আমাদের প্রকৃতি বর্ষা এলে নতুন করে সাজে, যেন কবির ঘরে প্রবেশ করে নতুন বউ। আর সেই নতুন বউকে ঘিরে একের পর এক কবিতা লিখে যায় কবি, যেখানে থাকে প্রেম, বিরহ, অভিমান এবং রোমাঞ্চ। এসব মূলত জনজীবনেরই অংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনই একজন সম্পর্ক স্থাপনকারী, যাঁর লেখায় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে বর্ষা ও জনজীবনের। রবীন্দ্রনাথ জনজীবনকে দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রকৃতিকে দেখেছেন হৃদয় দিয়ে। ফলে তিনি সীমার মধ্যে পান অসীমের স্পন্দন। তাই এক ফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়ায় কিংবা মেঘের ছায়ায় গভীর রোমান্সে ভরে ওঠে একটা কবিতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে বর্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পরম ভালোবাসায়। বর্ষার গহিনের যে রূপ, তার অন্তরের যে আকুতি, বৈচিত্র্য, ছন্দ ও লয়, সবই রবীন্দ্রনাথকে আপ্লুত করেছে। সব ঋতুই তাঁর কাছে প্রিয় হলেও বর্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিঃসন্দেহে বেশি। তাঁর লেখায় রয়েছে বর্ষার আগমন, সৌন্দর্য, আক্রমণ ও প্রস্থান। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন গান, কবিতা, ছড়া, গল্প এমনকি জীবনস্মৃতিও। তাঁর বর্ষাবন্দনা এতই সমৃদ্ধ যে বাংলা সাহিত্যে এমন বর্ষাবন্দনা মেলা ভার। তাই বর্ষা উদযাপনে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত কোনো বিকল্প নেই।

 

‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো করো স্নান নবধারাজলে...’এ গানটিতে বর্ষার নবধারাকে আহ্বান করা হয়েছে। এসব গান বাদলমুখর দিনে-রাতে মাতাল করে। একপ্রকার মাদকতা সৃষ্টি করে। শ্রাবণ আর রবীন্দ্রনাথ একসুরে গাঁথা। বরষার ফোঁটা পড়লেই গেয়ে উঠি– ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে/পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে...’। বরষা নিয়ে, মেঘ নিয়ে এমন অসংখ্য গান লিখেছেন বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋতুবৈচিত্র্যের ভিত্তিতে লেখা গানের সংকলন হচ্ছে ‘গীতবিতান’। এখানে ১১৫টি বর্ষার গান আছে। গীতবিতানের পাতায় পাতায় বর্ষা আসে সৌরভে, বর্ষা আসে বিরহে। এতেই বোঝা যায়, কবির প্রিয় ঋতু হচ্ছে বরষা। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না...’– জনপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের এ গানটি প্রেমিকের মন উচাটন করে তোলে; বিরহী করে তোলে। সঙ্গীর সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সংগীতে/রিমঝিম রিমঝিম...’এমন গান শুনতে শুনতে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি প্রকৃতিতে, বরষায়, মেঘের মধ্যে।

 

কবি তার জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর...’। কখনো রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,/আকাশ-ভাঙা আকুলধারা কোথাও না ধরে’। কবির শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসব হয়েছিল, তখন রবিঠাকুর গেয়েছিলেন-‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে’। কবিগুরুর গানের বাণীতে কালজয়ী কত বর্ষার গান। বৃষ্টিবিলাস ও বর্ষা বন্দনায় রোমান্টিক কবি বিরহ কাতরতায় যেন লিখে রাখেন- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘন ঘোর বরিষায়’।

এসব অমর সাহিত্য কবি রচনা করেছেন বর্ষাকে ভালোবেসে। বর্ষাও তার প্রতিদান দিয়েছে কবিকে ভালোবাসার মাধ্যমে। সে ভালোবাসার প্রকাশ হয়েছে বর্ষার দিনে কবির পরলোক গমনের মাধ্যমে। ২২শে শ্রাবণের আনন্দ অশ্রুতেই কবির বিদায় হয়েছে। কিন্তু বর্ষা নিয়ে আমাদের মনের সকল অনুভূতিই তিনি রচনা করে রেখে গেছেন। আর এই সাহিত্য সম্পদ নিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবিকে রোমন্থন করছে। এ ধারা চলমান থাকবে অনন্তকাল। কারণ কবিগুরুর সাহিত্য বাদ দিলে তো বাঙালির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়।

 

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen