বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান নবদ্বীপ
নবদ্বীপের পাঠাভ্যাস দেখে ইংরেজরা এসে এই শহরকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলেছিল। তবে তারও তিনশো বছর আগে এই শহরের বিদ্যাচর্চা বিস্মিত করেছিল খাস মিথিলাকেও। নব্যন্যায়ের চর্চা তখন মিথিলা ছাড়া আর কোথাও তেমন হত না। ন্যায়ের উঁচু বেড়া টপকে নব্যন্যায়ের নতুন চিন্তা ধারণ করাই এক রকম অসম্ভব ছিল।
বর্তমানে নবদ্বীপকে হেরিটেজ শহরের তকমা দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু, সেখানকার ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে সংরক্ষণ ঠিক মতো হবে তো? হলে, কবে থেকে, কীভাবে? এ নিয়ে ধোঁয়াশায় নবদ্বীপ। একসময়ে বলা হত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এরকমই টোলে পড়ানো হত সংস্কৃত....এখন সেখানে গরু ঘুরে বেড়ায়। খোলা মাঠে পড়ে আছে বল্লাল সেনের ঢিপি। একসময়ে যা ছিল সেন রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ, কালের নিয়মে তাই মাটির ঢিপিতে পরিণত হয়েছে। ঢিপির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে ইতিহাস। সে দিকে আজ আর সেভাবে কেই বা ফিরে তাকায়।
নদিয়া জেলার নবদ্বীপে জন্মেছিলেন চৈতন্যদেব । তিনি যেমন বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব, তেমনি ১৬ শতকের বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। মধ্যযুগ নবদ্বীপ ছিল সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার পীঠস্থান। নব্যন্যায় দর্শনের কেন্দ্র। পাণ্ডিত্যের জন্য রঘুনাথ শিরোমণির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। তন্ত্রশাস্ত্রে অবদান রাখেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। দুরদূরান্ত থেকে পড়ুয়ারা আসতেন বিদ্বান হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে। যে কারণে ‘বাংলার অক্সফোর্ড’ নামে পরিচিত হয় নবদ্বীপ।
এই শহরের নাম কীভাবে এল? তা নিয়ে রয়েছে একাধিক মত। কেউ বলেন, ‘নব’ মানে নতুন। তার সঙ্গে ‘দ্বীপ’ জুড়ে ‘নবদ্বীপ’। সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন সিরাজির বইতে নবদ্বীপকে ‘নওদিয়া’ বলা হয়েছে। যার অর্থ ‘নতুন দেশ’। কবি কর্ণপুর তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃতাম্’ কাব্যে শহরটিকে ‘নবীন দ্বীপং’ বলে উল্লেখ করেন। আবার কারো কারো মতে, নয়টি দ্বীপের সমষ্টি হল নবদ্বীপ।
চৈতন্যদেব ভক্তিবাদ প্রচার করার ফলে বাংলার সমাজ, সাহিত্য, শিল্পে বিপ্লব দেখা যায়। নবদ্বীপের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তবে, এই শহরে কেবল বৈষ্ণব নয়, শৈব, শাক্ত এবং বৌদ্ধ উপাসনারও বিকাশ ঘটে। তাই ধর্মীয় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে সহজেই। রাস উৎসব বা শাক্ত রাস, পট পূর্ণিমা, কিংবা রাস কালীপুজো নবদ্বীপের এক প্রধান উৎসব। একই অনুষ্ঠানে নানান প্রতিমার পুজো। দর্শনীয় জায়গার মধ্যে আছে শ্রীচৈতন্য মঠ, মহাপ্রভু মন্দির, যোগপীঠ, রাধারানি মন্দির, মায়াপুরে ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দির, ভজন কুটির, সমাধি মন্দির, পূর্বস্থলী পাখিরালয়।
Comments.