শুভ জন্মাষ্টমী: শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি

জন্মাষ্টমী হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী লক্ষত্র যোগে কৃষ্ণ মধুরায় কংসের কারাগারে মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর এই জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী বলা হয়।

শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী সম্পর্কে জানা যায়, দ্বাপর যুগে অত্যাচারী রাজা কংসের নৃশংসতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল মথুরাবাসী (ভারতের)। কংসের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করে তারা। ভক্তের ডাকে সাড়া দেন ভগবান।


একদিন আদরের ছোট বোন দেবকী ও তার স্বামী বসুদেবকে নিয়ে রথে চড়ে যাচ্ছিলেন রাজা কংস। এমন সময় দৈববাণী হলো, ‘বোন দেবকীর অষ্টম সন্তানই হবে তোর মৃত্যুর কারণ।’
দৈববাণী শুনে সঙ্গে সঙ্গে বোনকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন রাজা কংস, তবে বসুদেব তাকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন, ‘আমাদের দুজনকে কারাগারে আটকে রাখুন। আমাদের সন্তান হলে আপনার হাতে তুলে দেয়া হবে। জন্মের পরই আপনি তাদের হত্যা করে নিজের প্রাণ সংশয় কাটাবেন।’


বসুদেবের যুক্তি কংসের মনঃপুত হলো। তিনি তাদের কারাবন্দি করলেন। তারপর থেকে একে একে ছয়টি সন্তান কংসের হাতে তুলে দেন দেবকি ও বসুদেব, তবে সপ্তম সন্তান হাতে নেয়ার পরই সে হাসতে হাসতে শূন্যে ভেসে যায়। যাওয়ার সময় সে কংসকে ‘তার মৃত্যু অবধারিত’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে যায়।


পরে ভাদ্র মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টমী তিথির রাতে অষ্টম সন্তানের জন্ম দেন দেবকি। সে রাত ছিল ঝড়-ঝঞ্চাপূর্ণ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কারাগারের ফটকে কোনো রক্ষী সে সময় পাহারায় ছিল না।


এমন সময় এক দৈববাণীতে সদ্যোজাত ছেলেসন্তানকে নিরাপদে গোকুলে নন্দ-যশোদা দম্পতির কাছে রেখে আসতে বলা হয়। এ সময় কারাগারের দরজাও খুলে যায়। ফলে বসুদেব ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছেলেকে নিয়ে গোকুলে যশোদার পাশে রেখে আসেন। আর সঙ্গে নিয়ে আসেন যশোদার সদ্যোজাত মেয়েকে। পরে গোকুলেই বড় হতে থাকেন শ্রীকৃষ্ণ। পরবর্তী সময়ে দ্বারকার রাজা হয়ে তিনি যুদ্ধে মথুরারাজ কংসকে পরাজিত ও হত্যা করেন।


সেই থেকে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বিশ্বাস করেন, পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়, তখনই ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর অবতার রূপে পৃথিবীতে আসেন। ষড়গুণ অর্থাৎ শৌর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন পূর্ণাবতাররূপে প্রকাশিত হন কৃষ্ণ।

অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর সবচেয়ে অপরূপ অবতার বলে মনে করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় জগতের সব সুখ লাভ হয়; মঙ্গল হয় পরিবার, দেশ ও সমাজের। তাই তো শুধু মথুরা নয়, শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই তিথিটি ভক্তিভরে পালন করে থাকেন।


তাদের বিশ্বাস, এই দিনটিতে ব্রত পালন করলে মনের ময়লা দূর হয়; সৎগুণের জয় হয় এবং এর ফলস্বরূপ মৃত্যুর পর জীবাত্মার মুক্তি হয়।


শ্রীমদ্ভগবতগীতায় বলা হয়, ‘যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে, আমি সেইভাবে তাকে কৃপা করি।’ এ বিশ্বাসেই মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় মত্ত বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।


হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে জন্মাষ্টমী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। নানা ভাবে এই উৎসব পালিত হয়। কোথাও তাঁর জীবনের নানা কাণ্ড গান, কীর্তন, গীতিনাট্য, নাটক, যাত্রায় অর্থাৎ রাসলীলার মাধ্যমে পালিত হয়। যার আধিক্য দেখা যায় মথুরা, বৃন্দাবন, মণিপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায়। আবার কোথাও দহি হান্ডি প্রথা অনুযায়ী, অনেক উঁচুতে মাখনের হাড়ি রাখা হয়। অনেকে মিলে সেখানে পিরামিড তৈরি করে হাড়ি ভাঙে। তামিলনাড়ুতে একে বলা হয় উড়িয়াদি। কেউ কেউ আবার তাঁর ছোট মূর্তি স্নান করিয়ে কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দোলনায় সাজিয়ে দেন। অনেক বাড়ির মহিলারা আবার দরজার বাইরে শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন এঁকে দেন। যাকে শ্রীকৃষ্ণের যাত্রা বলা হয়। কেউ কেউ আবার শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে নন্দের উপহার বিতরণের কাহিনী অনুযায়ী নন্দোৎসব পালন করেন।

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen